হামার ফির ঈদ কিসের বাহে? পেটোত নাই ভাত, থাইকপার নাই জাগা। হামরাতো বাঁচি থাকতে মরি গেচি। করোনাক ভয় করি বা লাভ কি!’ নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর বাঁধে নতুন করে ঝুপড়িঘর তোলার সময় ক্ষোভ-দুঃখে এমন কথা বলেন শংকরদহ চরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব নবির উদ্দিন।
শুধু তিনি নন, ঈদ-করোনাকে ছাপিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে বেড়াচ্ছে ভাঙনের শিকার তিস্তাপারের অনেক পরিবার। বন্যা-ভাঙনে বিরান হওয়া চরে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি সারিয়ে তুলতে ভবিষ্যতের চিন্তা বাদ দিয়ে হালের গরু বেচতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। বন্যার পানি নেমে গেলেও ভাঙনের আশঙ্কায় বাড়ি ছেড়ে পাশের সড়কে অবস্থান করছে কেউ কেউ। ঈদ-করোনার চিন্তা মাথায় নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে চরের বাসিন্দারা।
সরেজমিনে গতকাল বুধবার শংকরদহ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বন্যার পানি নেমে গেলেও শুরু হয়েছে তিস্তার ভাঙন। চোখের সামনে ঘরবাড়ি, গাছপালা, বাঁশঝাড়সহ তিস্তায় বিলীন হচ্ছে গ্রাম। এবার বন্যায় প্রায় ৩০০ পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। এলাকার একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শংকরদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আশ্রয়ণ কেন্দ্রের মসজিদ নেই। ভাঙনের তীব্রতা ক্রমে এগিয়ে আসছে আশ্রয়ণ কেন্দ্রটির দিকে। আতঙ্কে সেখানে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলো তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে।
গতকাল সকাল ১১টার দিকে ওই চরে যাওয়ার পথে দেখা যায়, বন্যার পানি কমে গেলেও সেখানে সহজে যাওয়ার কোনো পথ নেই। সম্প্রতি বন্যায় রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। সর্বস্বান্ত লোকজন থালাবাসন, হাঁস-মুরগি ও কাঁথা-বালিশসহ ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করা সংসারের জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নদীর কিনারায়। নৌকা এলেই তারা চলে যাবে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শংকরদহ আশ্রয়ন কেন্দ্রে থাকত ৩০টি পরিবার। অন্য এলাকায় নদীভাঙনে এরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। এবারে গোটা আশ্রয়ণ কেন্দ্রটি হুমকির মুখে পড়ায় সেই ঠিকানা তাদের বদল করতে হচ্ছে। এরই মধ্যে ২০ পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। এ ছাড়া আশ্রয়ণ কেন্দ্র লাগোয়া আরো প্রায় ১৫০টি পরিবার সেখানে বসতি গড়েছিল। কিন্তু গৃহহীন হয়ে তারা বাধ্য হয়েছে অন্যত্র চলে যেতে। এর মধ্যে জালাল উদ্দিন, সহিদার রহমান, আনোয়ারুল ইসলাম, আবুল কাশেমসহ ৫০ পরিবার ভাঙনের হাত থেকে ঘরবাড়িসহ সংসারের কিছুই বাঁচাতে পারেনি।
কয়েকটা মুরগি, এক বোঝা খড়ি আর কিছু থালাবাসন নিয়ে নৌকায় উঠছিলেন শংকরদহ গ্রামের ছমিরন বেওয়া। তিনি বলেন, ‘হামার অ্যাটে থাকি য্যান লক্ষ্মী ছাড়ি পালাইচে। সেই বাদে হামার আইজ এই অবস্থা। এবারের বন্যায় চোকের সামনোত ঘরবাড়ি সউগ ভাসি নিয়া গেইল। অ্যাটে থাকি কী করি-আর কায় হামাক খাবার দেয়। জাগার মায়া ছাড়ি যাওচি, দেকি আল্লার দুনিয়াত কোনটে অ্যাকনা ঠাঁই মেলে?’
রাস্তায় বাস করা শরিফা বেগম ও আপেল মিয়া জানান, বেড়িবাঁধের আর দুই থেকে তিন ফুট ভাঙলেই পানি এসে তাদের বাড়ি তলিয়ে যাবে। তখন মালামালসহ ঘরবাড়ি সরানোর সময় পাওয়া যাবে না। তাই তাঁরা রাস্তায় থাকছেন। ভাঙন থামলে বাড়িতে ফিরবেন।
লক্ষ্মীটারি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, ‘বন্যা ও তিস্তার ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এখানে। এলাকায় এখন কাজ নাই, খাবারও নাই। মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় এখানকার বাসিন্দারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ভাঙনের ভয়ে আতঙ্কিত বেশ কিছু পরিবার সংসারের জিনিসপত্রসহ পাশের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে।’