গত বছর ইস্টার সানডের সন্ত্রাসী হামলার পর আতঙ্কিত পর্যটকরা শ্রীলংকা ছেড়ে চলে যায়। এরপর করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সারা বিশ্বে পর্যটনের উপর আঘাত আসে। সব মিলিয়ে শ্রীলংকার অর্থনীতির উপর বড় ধরনের আঘাত এসেছে এবং সে কারণে এখন সাহায্যের আশায় চীনের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীদের দিকে ঝুঁকছে তারা।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির অর্থনীতি ২০১৯ সালে ২.৩ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এ বছর সেটা ৩ শতাংশ কমে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। সে কারণে কলম্বোর সরকার মার্চ মাসে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব চায়না ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা দেয়ার জন্য বেইজিংয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছে। এছাড়া ‘করোনাভাইরাস সহায়তার’ জন্য এপ্রিলে বিশ্ব ব্যাংকের অনুমোদিত ১২৮.৬ মিলিয়ন ডলারও নিচ্ছে তারা।
অন্যদিকে ভারতের কাছে শ্রীলংকা সাহায্যের যে আবেদন করেছিল, সেটার কোন ইতিবাচক জবাব মেলেনি বলে মনে হচ্ছে। বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের কারণে কলম্বোর উপর ভারতের ঐতিহাসিক প্রভাব কমে যাচ্ছে দেখেও নয়াদিল্লী এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি।
২০০৩ সাল থেকে ভারত দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশটিতে ১.২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ঢেলেছে। আবাসন উন্নয়ন থেকে থেকে নিয়ে দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে নতুন স্কুল নির্মাণের জন্য এই অর্থ ব্যায় করা হয়েছে। চীন তাদের কোমল শক্তির ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ায় ভারতও সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপর জোর দিয়েছে এবং বলেছে যে, ভারত আর শ্রীলংকার মধ্যে অভিন্ন বৌদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানী কলম্বোর বিখ্যাত ১০৪ মিলিয়ন ডলারের লোটাস টাওয়ারটির অনুপ্রেরণা এসেছে লোটাস সুত্র থেকে, যেটা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী একটি গ্রন্থ। এই টাওয়ারের জন্য অর্থ ও ঋণ দিয়েছে চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক।
জুনে ভারতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় শ্রীলংকা চার মাস আগে ভারতের কাছে তাদের ৯৬০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ শোধের বিষয়টি স্থগিত রাখার আবেদন করেছিল এবং দেশের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য ১.১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময় সুবিধা চেয়েছিল। কিন্তু ভারত এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি।
কলম্বোর সাম্প্রতিক পদক্ষেপের কারণে প্রশ্ন উঠেছে যে, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা কি দেশকে যুক্তরাষ্ট্র আর তাদের মিত্রদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, বাণিজ্য থেকে নিয়ে প্রযুক্তি – সব ক্ষেত্রেই বেইজিংয়ের সাথে ব্যাপক বিবাদ রয়েছ ওয়াশিংটনের। আবার সীমান্ত বিবাদ নিয়ে ভারতের সাথেও চীনের সঙ্ঘাত সম্প্রতি উসকে উঠেছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে, শ্রীলংকা সরকার কলম্বোতে জাপানি অর্থায়নের হালকা রেলওয়ে প্রকল্প বাতিল করে। তারা জানিয়েছে যে, মার্কিন বিদেশী ত্রাণ সংস্থা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কোঅপারেশান থেকে তারা ৪৮০ মিলিয়ন ডলারের কোন সহায়তা নেবে না।
এখন কলম্বো বন্দর নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, যেখানে নতুন ইস্ট কন্টেইনার টার্মিনালটি যৌথভাবে উন্নয়নের কথা রয়েছে শ্রীলংকা, জাপান আর ভারতের। তবে কর্মীরা দাবি করছেন যাতে এই ফ্যাসিলিটিটি শ্রীলংকার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
শ্রীলংকার পররাষ্ট্র সম্পর্কের পর্যবেক্ষক পালিথা কোহোনা এর আগে জাতিসংঘে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মনে করেন, দিল্লী থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাটা দেশের জন্য ভালো হবে।
তিনি বলেন, “ভারতের খুব ঘনিষ্ঠ হওয়াটা আমাদের উচিত হবে না, কারণ আমাদের যে অর্থায়ন দরকার, একমাত্র চীনই সেটা দিতে পারবে। আমাদের দেয়ার মতো কোন অর্থ ভারতের নেই”।
তিনি বলেন, “বড় শক্তিগুলো কিভাবে তাদের শক্তির চর্চা করে, সেটার ব্যাপারে সচেতন না হলে, শ্রীলংকা টিকতে পারবে না। আমাদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, কিভাবে বড় ও ছোট দেশগুলো একে অন্যের সাথে লেনদেন করছে”।
“অন্যরা আমাদের নিয়ে বা এই অঞ্চল নিয়ে কি পরিকল্পনা করছে, আমাদেরকে সেটা বিশ্লেষণ করতে হবে। সেভাবেই উভয় দেশের সাথে সম্পর্ক থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি”।