এরশাদ সরকারের আমলের বানিজ্য মন্ত্রী খুলনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা লেঃ কর্নেল (অবঃ) এইচ এম আব্দুল গফফার (বীরউত্তম) আজ রবিবার সকাল ১০টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আরাজি-সাজিয়ারা গ্রামে। ১৯৭৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন তিনি। তার স্ত্রীর নাম হোসনে আরা বেগম। মৃত্যুকালে দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং মায়ের নাম রহিমা খাতুন। সুত্রমতে, ১৯৭১ সালে এমএ গাফফার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চ তিনি অবস্থান করছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ২৭ মার্চ তারা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। মন্দভাল সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘কে’ ফোর্সের অধীন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে বিলোনিয়া, ফেনী ও চট্টগ্রামের নাজিরহাট এলাকায় যুদ্ধ করেন খুলনার এ কৃতি সন্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধে আবদান : ১৯৭১ সালের ৭-৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত সীমান্ত এলাকায় সালদা নদীতে বেশ শক্তিশালী যুদ্ধ হয়। সালদা নদীর পাশেই ছিলো ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথ। এখানে রেলস্টেশনও ছিল। ১৯৭১ সালে এই রেলস্টেশন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই রেলস্টেশন ও এর আশপাশ এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল একযোগে আক্রমণ চালাল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে। এর মধ্যে একটি দলের নেতৃত্বে এম এ গাফফার হালদার। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করছেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রায় দিশেহারা। বিজয় প্রায় হাতের মুঠোয়। এমন সময় হলো বিপর্যয়। মুক্তিবাহিনীর একটি দলের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। এম এ গাফফারের নেতৃত্বাধীন দলের মুক্তিযোদ্ধারা তখন কিছুটা চাপের মধ্যে থাকলেও তিনি সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলেন। তার সাহসিকতায় উজ্জীবিত হলেন তার দলের সব সদস্য। সেপ্টেম্বর মাসে একই এলাকায় বেশ কয়েকবার প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ (বীরউত্তম) সালদা নদী রেলস্টেশন দখল করার পরিকল্পনা করেন। তার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ৭ অক্টোবর সালদা নদী ও এর আশপাশ এলাকায় বিভিন্ন পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা নয়নপুর থেকে সালদা নদী রেলস্টেশনে আশ্রয় নেয়। এখানেও এম এ গাফফার তার দল নিয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। তখন আবদুস সালেক চৌধুরীর (বীর উত্তম) নেতৃত্বাধীন দলের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে তারা পেছনে সরে যেতে বাধ্য হন। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সেদিনের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এরপর খালেদ মোশাররফ সালদা নদী দখলের দায়িত্ব অর্পণ করেন এম এ গাফফারের ওপর। ৮ অক্টোবর তিনি তার দল নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর আবার আক্রমণ চালান। সারা দিন সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পরদিন ৯ অক্টোবর এম এ গাফফার হালদার যুদ্ধ কৌশল পরিবর্তন করে নতুন পরিকল্পনা নেন। তার এই পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয়। প্রথমে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। পাকিস্তানিরা তাদের পাল্টা আক্রমণ চালায়। এই সুযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দুটি দল সালদা নদী রেলস্টেশনে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি শিকার করে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। সালদা নদী রেলস্টেশন মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালিয়েও ওই রেলস্টেশন পুনর্দখল করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এইচএম এ গাফফারকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৭। তাঁর প্রকৃত নাম হালদার মোঃ আবদুল গাফফার। এম এ গাফফার হালদারের পৈতৃক বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আরাজি-সাজিয়ারা গ্রামে হলে সায়াহ্নে বাস করতেন ঢাকায় (ওয়ালসো টাওয়ার, ২১ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ)। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। পরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃত্যুতে খুলনা একজন বীরসন্তানকে হারালো