মো নুরুন্নবী : বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। একই সাথে অনলাইন-অফলাইনে গুজব ছড়িয়ে সর্বসাধারণকে আতঙ্কিত করার অপচেষ্টাও দৃশ্যমান হচ্ছে। এহেন কার্যক্রম অবশ্যই নিন্দনীয়। এমতাবস্থায় মানুষকে সঠিক তথ্যদিয়ে মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন করতে হবে। বাঁচাতে হবে নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, দেশবাসী সবাইকে।
বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) নির্দেশনা অনুযায়ী সচেতনতার সাথে করোনা প্রতিরোধ করতে স্বচেষ্ট হলে এ রোগ থেকে হয়তো বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ডাক্তারদের চেয়ে মানুষ আলেমদের কথা বেশি বিশ্বাস করে। তাই সর্বস্তরের মুসলিম সমাজে করানা ভাইরাস বা মহামারী ও ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে ইসলামী বিধান জানিয়ে দিতে হবে। একইভাবে চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলতে আলেম সমাজের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যেহেতু এ রোগের এখনও চিকিৎসা পদ্ধতি বা প্রতিষেধক তৈরি করা সম্ভব হয় নি, সেহেতু বাড়াবাড়ি না করে এবং আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া উচিত।
আমরা জানি, সারাবিশ্বে অতীতে বিভিন্ন সময়ে প্লেগ, কলেরা, ফ্লুৃসহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণঘাতি মহামারী হয়েছিল। তৎমধ্যে নোভেল করোনা ভাইরাস বর্তমানে ভযঙ্কর রূপ ধারণ করেছে, দিন দিন এর প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই প্রতিষেধক তৈরিতেও বেগ পেতে হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, বিশ্বের প্রায় ৬ কোটি মানুষ এ ভাইরাসে মারা যেতে পারে।
গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান প্রদেশে সনাক্ত হওয়া এ নোভেল করোনা ভাইরাস বর্তমানে মহামারী আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ২০৬টি দেশ ও অঞ্চলে করানো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবকে ‘মহামারী’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তাছাড়াও চীনের চেয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বাড়তে থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস অ্যাডানম গেব্রিয়াসিস ইউরোপকে প্রাণঘাতী ভাইরাসটির কেন্দ্রস্থল বলেও দাবি করেছেন। ইরান, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে দিন দিন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা আক্রান্তের হার। প্রতিমিনিটেই ঝরছে প্রাণ। অনেকদেশ লকডাউন করা হয়েছে, জারি করেছে কারফিউ, আকাশপথ-সড়কপথ-জলপথ বন্ধ। অর্থাৎ কার্যত সারা বিশ্ব পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সারা বিশ্বের ন্যায় লকডাউন হচ্ছে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থান। এদিকে করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে প্রথম ধাপে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৭ ই মার্চ থেকে ৩১ শে মার্চ পর্যন্ত ছুটি ঘোষনা করেছে শিক্ষা মন্ত্রনালায।পরবর্তীতে এই ছুটি ৩০ শে মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সকল শিল্প কারখানা প্রথম ধাপে ২৬ শে মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। পরবর্তী ধাপে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয় এবং নোটিশে সংযুক্তি থাকে পরিস্থিতি কন্ট্রোল এ না আসলে এই ছুটি বাড়তে পারে বলে কতৃপক্ষ জানান।এ সময় শুধু পুলিশ ও হাসপাতাল ছাড়া সব ধরনের সরকারি সেবা বন্ধ থাকবে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বমন্দা সৃষ্টি হবে এবং ভেঙ্গে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। তাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে করোনা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে হবে।
দুঃখের সংবাদ হচ্ছে যে, সারা বিশ্বের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার পরও এখনো এর প্রতিষেধক প্রস্তুত করতে সক্ষম হননি। তবে হয়তো অল্প সময়ের মধ্যে তা প্রস্তুত হতে পারে বা হয়তো আরো সময় লাগতেও পারে। সেই পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধ করতে হবে এবং সচেতন হতে হবে সবাইকে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী, করোনা থেকে বাচাঁর একমাত্র উপায় ঘরে অবস্থান করা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, হাত ধোয়া, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, করোনা আক্রান্ত থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি। তিক্ত হলেও সত্য যে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির পর প্রবাসীরা তড়িঘড়ি করে দেশে এসেছেন এবং সাথে নিয়ে এসেছেন করোনা ভাইরাস, তার বলি হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট প্রবাসী, তাঁর পরিবার, প্রতিবেশী সবাই। অথচ, আমরা দেশে বসবাসকারী ও রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসীরা যদি মুসলিম হিসেবে ছোঁয়াচে রোগ বা মহামারী রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় করণীয় সম্পর্কে জ্ঞাত হতেন, তবে আমাদের দেশে করোনা এত আতঙ্ক মূর্তিমান হতে পারতো না। একটু সচেতন হলে ৩৩০ জন করোনা আক্রান্ত বা ২১ জন মৃত্যু বরণ করতেও হতো না।
সাধারণতঃ বেশির ভাগ মহামারীই সংক্রামক। তাই মহানবী (দ.) মহামারীর সংক্রমণ রোধে আক্রান্ত অঞ্চলে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। একইসাথে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্যত্র যেতেও নিষেধ করেছে। মহানবী (দ.) বলেন, ‘কোথাও মহামারী দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা ছেড়ে চলে এসো না। আবার কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করে থাকলে, সে জায়গায় গমন করো না।’ (তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং: ১০৬৫)
সহীহ বোখারি শরীফের ৫৭২৯ হাদিসের বর্ণনায় দেখা যায় যে, সিরিয়ায় মহামারী দেখা দিলে হযরত ওমর (রা.) তার গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফর স্থগিত করেন।
আরো বিভিন্ন হাদিস শরীফে নবী করীম (দ.) মহামারী অবস্থায় একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে নিষেধ করেছেন।। মহামারী দেখা দিলে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী বা বর্তমান ডাক্তারী নির্দেশনা অনুযায়ী হোম কোয়ারেন্টাইন এর নির্দেশনা মুসলমানদেরকে ১৫শত বছর পূর্বে মহানবী (দ.) দিয়েছেন। অথচ, তা অনুসরণ না করে সর্বত্র ঘুরাফিরা করে আমরা পরিবার-প্রতিবেশী, সর্বোপরি দেশবাসীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। তা নিশ্চয় কোন মুসলমানের কাজ হতে পারে না।
হাদিস শরিফে আছে, মহানবী (দ.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে বা কষ্ট না পায়।’ অথবা ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি।
সাধারণ সম্পাদক, চাঁদপুরস্থ কচুয়া ছাত্রকল্যাণ সংস্থা,চাঁ.স.